এই ক্ল্যেইকার্ড গ্রহটার জন্ম ইতিহাশ, গ্রহটা আবিস্কারের গোঁড়া থেকেই খুব স্পষ্ট অক্ষরে লিখে রেখেছিল পৃথিবী গ্রহের মানুষ, বা আমাদের পূর্বপুরুষরা ! আমাদের এই ক্ল্যেইকার্ড গ্রহকে ওরা যখন প্রথম আবিষ্কার করেছিল, তখন আনন্দের মহা উৎসবে গোটা পৃথিবী একসাথে নেচে উঠেছিল ! সে আনন্দ ছিল বাঁধ ভেঙ্গে আশা স্বচ্ছ জলে নিজেকে ধুয়ে পরিষ্কার করার মত, বা পৃথিবীর ভয়াবহ বৈরিতা থেকে মুক্তি পাবার আনন্দ ! কারণ ক্ল্যেইকার্ড'ই একমাত্র গ্রহ, যার ভর আয়াতন ছাড়া সবকিছুই পৃথিবীর সাথে হবুহুব মিল আছে।
কিন্তু সে উৎসব বা ক্ল্যেইকার্ড জয়ের আনন্দ, মিটে যেতে বেশি সময় লাগেনি, যখন তারা ভালভাবে ঘেঁটে ঘুঁটে জানলো, পৃথিবীর তাপমাত্রার থেকে ক্ল্যেইকার্ডের তাপমাত্রা অনেক বেশি ! যা- যে কোন জীবন্ত সরিরকে ঝলসে দেবার মত ! আর পৃথিবী থেকে ক্ল্যেইকার্ড গ্রহের দূরত্বও অনেক বেশি ! তাই পৃথিবী গ্রহের মানুষ সম্ভব্য আশ্রয় পেয়েও হারাবার হতাশায় ভেঙ্গে পড়ল ! কিন্তু বিজ্ঞান দমে যাওয়ার পাত্র না, তাই ক্ল্যেইকার্ড'কে নিয়ে চলতে থাকল তাদের গভীর পর্যবেক্ষণ।
মহাশূন্যের অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী এবং শক্তিধর গ্রহ ক্ল্যেইকার্ড ! আর সেই ক্ল্যেইকার্ড গ্রহের প্রধান সিটির নাম ক্ল্যেইবার্ক।
ম্যট হ্যলেক্স ক্ল্যেইবার্ক সিটির বিশেষ একটি ঘরে বসে, পৃথিবীর নিশ্চিহ্ন হয়ে হারিয়ে যাবার এই গল্পটি শোনাচ্ছে, তার নয় বছরের ছেলে প্যইটর'কে ! আর ছোট্ট প্যইটর তার বাবার মুখের দিকে অভূতপূর্ব কৌতূহলে তাকিয়ে থেকে গভীর মনোযোগ দিয়ে বাবার কথাগুলো শুনছে, আর তাদের সামনের ওয়াল-স্কিনটাই বিভিন্ন তথ্য প্রতিমুহূর্তে ভেসে উঠে জানান দিচ্ছে, কোন্ গ্রহের কথাই অবস্থান, এবং তারা নভোমণ্ডলের কোন স্থানে বসে আছে ! এইরকম জানা অজানা নানান রকমের বিচিত্র সব তথ্য। ছোট্ট প্যেইটর আর মাঝ বয়সী হ্যলেক্স দুজনেই বিস্ময়ে ডুবে ঘাঁটাঘাঁটি করছে তাদের সামনে থাকা জ্যোতির্বিজ্ঞানের উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর হাই স্পিড কম্পিউটার টি ! আর সমস্ত তথ্য উপাত্ত খুব যত্ন সহকারে মনোযোগ দিয়ে বোঝাচ্ছে প্যইটর'কে।
হ্যলেক্স আবার বলতে লাগলো-
তারপর পৃথিবী গ্রহের মানুষদের মাথা থেকে ক্ল্যেইকার্ড চিন্তা একরকম হারিয়েই গেলো ! কারণ পৃথিবীর বাইরে খুব তাড়াতাড়ি নতুন বাস্থান খুঁজে না পেলে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না ! তাই ক্ল্যেইকার্ড ভাবনা সাময়িক স্থগিত রেখে প্রাণপণে অন্য গ্রহ খুজতে লাগলো। আর এদিকে পৃথিবীতে তখন দম বন্ধ হয়ে আসছিলো সবার ! কারণ যখন তখন ভয়ানক ঝড় বৃষ্টি, কারণে অকারণে ভূমিকম্প, ঝিল্লী-বায়ুমণ্ডল ভেদ করে অনায়েসে অতি বেগুনি রশ্নির পৃথিবীতে ঢুকে পড়া, মানুষ মানুষে সংঘাত পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়া, বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যাওয়া ! এই রকম নানান সমস্যায় পৃথিবী তখন মানুষ বসবাসের অযোগ্য হয়ে নোংরা হয়ে গেছিল!
আর এভাবে অকাল মৃত্যুর সাথে বেশিদিন থাকা যায় না, তাই চরম উদ্বিগ্নতা মানুষকে দিশেহারা করে দিলো ! মানুষ তখন বুঝে গেলো, পৃথিবীর এই দুষিত মাটি, বায়ু, জল, মহামারী ভাইরাসে, আর বেঁচে থাকার মিথ্যে লড়াই করে লাভ নেই ! তাই তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, বিজ্ঞানের সমস্ত বুদ্ধি মত্তা দিয়ে বাস উপযোগী বিকল্প গ্রহ বা একটু আশ্রয় খোঁজ করা শুরু করলো !
তারপর অনেক বাধা-বিঘ্নতার চড়াই উৎরাই পার করে, জীবন বাজি ধরে, পৃথিবীর খুব নিকটবর্তী গ্রহ চাঁদে এসে আমাদের জীবন রক্ষা করেছিলো !
আর সেই যে পৃথিবী ছাড়ল মানুষ, আর ফেরা হয়নি সেখানে ! এখন মনে হয় পৃথিবী জুড়ে ভুতেরা বাশ করে, যে ভুত গুলর জন্য পৃথিবী ধ্বংস হয়েছিল.....।
তারপর চাঁদে এসে রচনা হল মনুষ্য সভ্যতার নতুন আরেকটা অধ্যায়।
কিন্তু চাঁদে প্রাই উল্কাপাত, ধূলিঝড়, বিজলীপাত সহ নানান রকম প্রতিকূলতা, গায়ে পড়ে শত্রু হত মানুষের ! তাই প্রথম দিকে সবকিছু গুছিয়ে উঠতে অনেক সময় এবং শক্তির অপচয় হল। তারপর চন্দ্রের লালচে মাটি জুড়ে, মাটির নিচে, মাটিঘর গড়ে তুলল মানুষ ! সেই মাটিঘর গুলো এতই বড় ছিল যে, সেখানেই স্কুল, কলেজ, রেস্টুরেন্ট, সহ প্রয়োজনীয় সবকিছু প্রয়োজন মত সাজিয়ে নিয়েছিল তারা ! বলা যায় মাটির নিচেই আরেকটা জগৎ গড়েছিল মানুষ ! তারপর সেখানেই অনেক আশা নিরাশা মাথাই করে পার হয়েগেল আমাদের পূর্বপুরুষদের আরও তিন'শ শতাব্দী .........।
আর ততদিনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেল, খাবার ব্যবস্থা কমে গেলো ! তার পর আবার সেই পৃথিবীর মত অবস্থা, মানুষ সবাই কোণ ঠাঁসা হতে লাগলো ! তখন হন্নি হয়ে পুনর্বার নতুন নির্ভরযোগ্য বাসস্থান খুঁজতে লাগলো চন্দ্র গ্রহের মানুষ !
এদিকে ধিরে ধিরে কমতে থাকা সূর্যের তেজ, যখন আরও কমে গেলো ! তখন আমাদের এই ক্ল্যেইকার্ড গ্রহে মানুষ বসবাসের যথার্থ পরিবেশ গড়ে উঠেছিল ! ক্ল্যেইকার্ডের উপর নজর রাখা তখনকার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সবাইকে জানিয়ে দিলো- এখন ক্ল্যেইকার্ড গ্রহে আমরা বাস করতে পারবো ! আর এ খবর ছড়িয়ে পড়ার কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হল ক্ল্যেইকার্ডে মানুষ বসতির প্রাণপণ প্রতিযোগিতা ! যার ধন-দৌলত, রোগমুক্ত সুস্থ সরির এবং শক্তি সমর্থ বেশি, কেবল তারাই ক্ল্যেইকার্ডে বাস করার সুজগ পেল, বাকি সবাই চাঁদের মাটিঘরেই থেকে গেলো । আর এখন তো দেখতেই পাচ্ছ, গোটা মহাবিশ্ব জুড়েই, উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ সমান তালে রাজত্ব করছে ।
হ্যলেক্স বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার হাতের কফিতে চুমুক দিয়ে থামল । তার দীর্ঘশ্বাসের বর্ণনা কিছুটা এই রকম- সূর্যের উষ্ণতা আরও কমে গেলে এই গ্রহটাও একদিন অন্ধকার হয়ে যাবে ! তার পর এভাবেই একদিন অন্ধকারে সমাপ্তি ঘটবে মানুষের !
প্যইটরের আগ্রহ এখনো একটুও কমেনি, সে হয়ত তার বাবার মত অতো গভিরের বিষয় গুলো ঠিকঠাক বুঝেনি, কিন্তু যতটুকু বুঝেছে তাতেই ওর মন খারাপ হয়ে গেল ! তাই সে আরও জানতে চাই, বর্তমান সহ সমস্ত বিষয় সমন্ধে বিস্তার ভাবে জানতে চায় ! কিন্তু আজকে অনেক সময় পার হওয়াই এখন তাদের বাড়ি ফিরতে হবে, বলে দিলো হ্যলেক্স ! সেই সাত সকালে ক্ল্যেইকার্ডের মধ্যাহ্ন সিটি ক্ল্যেইবার্ক'কে এসেছে তারা ! আর এখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে তবু বাড়ি ফেরার নাম নেই।
প্যইটরদের বাড়ি থেকে এই ক্ল্যেইবার্ক সিটিটা প্রায় আড়াই লক্ষ পঁচিশ হাজার মাইলের পথ ! কিন্তু তাতে কি, বাড়ি ফিরতে মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যপার ! আর সব থেকে মজার ব্যপার হল ক্লেককার্ড গ্রহটায় স্থল পথ নেই বললেই চলে ! শুধু পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেক শহরে প্রধান প্রধান কিছু মহাসড়ক আছে, যেগুলো রাস্তা ব্যবহার করা হয় শুধু ভারি ভারি মাল-সামানা আদান প্রদানের জন্য ! তাছাড়া স্থল পথ শখের বশে ছাড়া, কেউ তেমন ব্যবহার করে না !
প্যইটর একটি ঘূর্ণমান আকাশ যানের উপর তার বাবার পাশাপাশি বসে আছে ! যানটার গতি সেকেন্ডে প্রাই একহাজার কিলোমিটারের মত ! ক্ল্যেইকার্ডের এই মনুষ্যবাহী যানে চড়েই এখন তারা বাড়ি ফিরবে ! প্যইটরের পাশের আসন গুলোয় আরও অনেকজন বসে আছে, তাদের অনেককেই পিটার চেনে। সবাইকে বেল্ট দিয়ে আসনের সাথে আটকে রাখা হয়েছে, যাতে চলন্ত অবস্থায় কারো কোন সমস্যা না হয়।
আকাশ যান এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের মাঝামাঝি এসে হটাৎ যানের ভেতর সাবধানী এল্রার্ট বেজে উঠলো ! যানের স্পিকারে বলা হচ্ছে এলিয়েন্সরা নাকি ক্ল্যেইকার্ডের পেসিডেন্ট 'ভ্যক্সনেক্স ফিক্সর'এর কাছে কি একটা কাজে এসেছে !
তাই আকাশ যানের স্পিড কমিয়ে সাবধানে যেতে বলা হচ্ছে।
এরপরেই হটাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল 'সিহনের' !!! ঘুম ভাঙ্গার পরে চিৎকার দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সিহন- আমি কোথায়? আমি কোথায়? বাবা আমরা কখন বাড়ি ফিরবো? বিজ্ঞান কলেজের হলরুমে সুয়ে থাকা সিহন মধ্যরাতে এভাবেই চেঁচিয়ে উঠল ! সিহনের চেঁচামেচি দেখে পাশে সুয়ে থাকা ছাত্ররা, ঘুম থেকে হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠে সিহনকে প্রশ্ন করলো "সিহন কি হয়েছে তোর?" সিহন কোন কথা বলছে না, ঝিম ধরে মূর্তির মত বিছানায় বসে আছে ! তার চোখেমুখে তখনো ক্ল্যেইকার্ডের ঘোর কাটেনি, বারবার ম্যট হ্যলেক্স, প্যইটরদের কথা মনে পড়ছে ! সিহন ব্যপার টা ভালকরে বোঝার জন্যে তার চারিপাশ ভালো করে দেখছে, আর বোঝার চেষ্টা করছে সে আসলেই কোথায় এখন ! মেসে তার রুমের সেই ভাঙ্গা ঘড়িটা টিক্ টিক্ শব্দ করে এনালগ টাইম বাতলে দিচ্ছে- এখন টাইম রাত ০১-৫০ মিঃ । মাথার উপরে তার চির চেনা হলুদ বাল্প টাও, রোজকার মত জ্বলে থেকে, ঠিক আলো দিচ্ছে ! তখন সিহন নিশ্চিত হল ক্ল্যেইকার্ডে না এখন সে পৃথিবীতেই আছে ! সিহন মনে মনে একটু মুচকি হেসে উঠ্ল, কিন্তু তখনো তার বুকের ধড়ফড়ানি একটুও কমেনি !
তারপর সিহনের স্বপ্নে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা পাশের সবাইকে খুলে বলল ! একেক জন একেক রকম মন্তব্য করে ঘুমিয়ে গেল। শুধু সিহনের চোখে ঘুম এলো না। সিহন মেসের রুম থেকে বাইরে এলো, বাইরে এসে, মাটি থেকে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ দুরের অন্ধকার আকাশে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ! আকাশ জুড়ে, হাজার হাজার তাঁরার মেলা বসেছে, কী হৈচৈ আজ তাঁরাদের ! সিহনের মনে হচ্ছে তাঁরারা আজ বড় কোন উৎসবে মাতওয়ারা হয়ে সবায় একসাথে আনন্দ করছে ! আর পূর্ণ যুবতী-চাঁদ সবার মাঝখানে ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে থেকে, তাঁরাদের হৈচৈ উপভোগ করছে ! সিহনের কাছে খুব বেশি অদ্ভুত মনে হচ্ছে আজকের রাত-আকাশটা ! হয়ত কিছিক্ষন আগের স্বপ্নটাই এভাবে ভাবতে সাহায্য করছে সিহনকে !
কিছুদিন পর............!
দেশ সহ দেশের বাইরের মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো- ভিনগ্রহের এলিয়েনরা নাকি মাঝে মাঝেই মধ্যরাতে এসে সিহনের সাথে কী সব কথা-বার্তা বলে যায়................।
বি.দ্রঃ
উপরোক্ত গল্পটি একান্তই নিজ খেয়ালে লিখা হয়েছে !
বাস্তবে সূর্যের আলো কমবে কী না, বা ক্ল্যেইকার্ড নামের কোন গ্রহ আছে কী না, সে ব্যপারে গল্পকার মোটেও নিশ্চিত না !
তাই সকলেই ধরে নিবেন, এই গল্পটি একান্তই নিজ খেয়ালের কল্পনা-শক্তির প্রতিবিম্ব-রূপ ছাড়া কিচ্ছু না !